২৯ এপ্রিল করুণ ও বিভৎস এক স্মৃতি

বিশেষ প্রতিবেদক •

আজ ২৯ এপ্রিল, ভয়াল এক স্মৃতি। ১৯৯১ সালের এই দিনে শরণাতীত কালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজারের উপকূলে আঘাত হানে। এ সময় প্রায় ১,৩৮,০০০০ মানুষ নিহত হয়। গৃহহীন হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ। হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। আজকের এই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো শিহরে উঠে উপকূলবাসী।

জানা যায় ৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ ২০/২৫ ফুট জলোচ্ছ্বাসে ঝড়ের গতি ঘন্টায় ২৬০ কি.মিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৬০ লক্ষাধিক মানুষ। ৬ লক্ষ ৪২ হাজার ৫২টি ঘর সর্ম্পূণভাবে এবং ৫৬ হাজার ২৭১টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৫০টি সেতু ও কালভার্ট এবং ১১২ মাইল দীর্ঘ উপকূলীয় বঁাধ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া-মহেশখালীর মাতারবাড়ী, পেকুয়ার মগনামা ও উজানটিয়া, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপসহ উপকুলীয় এলাকার লোকজন এখনো আতংকে রয়েছে বলে যানা যায়। এপ্রিল মাস আসলে ভুক্তভোগী লোকজন ভয়াল স্মৃতির কথা ভুলতে পারে না।

এ দিনটি স্মৃতিবিজড়িত ও বেদনাক্ষত। বারবার বলে আসা বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই টেকসই বেড়িবঁাধ দ্রুত নির্মাণ না হলে উপকূলীয় লোকজনের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

আজকের এই দিনকে ঘিরে কক্সবাজারস্থ কুতুবদিয়া সমিতি, কুতুবদিয়া ছাত্র পরিষদ, কুতুবদিয়া উন্নয়ন পরিষদ, উপকূল বঁাচাও আন্দোলন ও ২৯ এপ্রিল স্মৃতি পরিষদসহ বেশ কিছু সংগঠন শোক র‍্যালী, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৯ এপ্রিল রাতটি ছিল করুণ ও বিভৎর্স। এ বেদনা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভুক্তভোগী লোকজন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়-১৮৯৭ সালে কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রামে ঘুর্ণিঝড়ে নিহত হয় ১৭ হাজার ৫০০ লোকজন। ১৯৬০ সালে কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে ২১০ কি.মি ঘন্টায় গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ৫ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলোচ্ছাসে প্রায় ৬ হাজার মানুষ মারা যায়।

১৯৬৩ সালে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে ২০০ কি.মি গতি সম্পন্ন ঝড়ে মারা গেছে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। ১৯৬৫ সালে কুতুবদিয়া, চট্টগ্রাম-নোয়াখালী ও বরিশালে ১৬০ কি.মি ঘণ্টা ও ৪ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলোচ্ছ্বাসে ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৮৬ সালে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সন্দীপ, হাতিয়া, নোয়াখালীতে ১৫৪ কি.মি ঘন্টায় ৪ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলোচ্ছাসে প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা যায়।

১৯৯১ সালে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বরিশালে ২২৫ থেকে ২৬০ কি.মি ঘন্টায় ৫ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলোচ্ছাসে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৯৭ সালে কুতুবদিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ১৮০ কি.মি ঘণ্টায় ৫ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জলোচ্ছাসে ২০০ এর অধিক মানুষ মারা যায়। এছাড়া ১৮২২, ১৮৭৬, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৮৮, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকার ২৬টি জেলায় চরমভাবে আঘাত হানে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে একই ভাবে রোয়াণু ও মোরা উপকুলীয় এলাকার উপর দিয়ে হালকাভাবে বয়ে যায়।

সবচাইতে শরণাতীত ৯১ সালের এপ্রিলের আজকের এই দিন। অরক্ষিত উপকুলবাসীদেরকে রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ আসন্ন বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই দ্রুত নির্মান করার দাবীয় জানিয়ে আসছে দ্বীপবাসী।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আরো সম্ভাব্য বিপর্যয় :

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের ব্যাপারে সবাই শংকিত। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী মানুষের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হতে নির্গত কতিপয় গ্যাসীয় পদার্থের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠের উষ্ণতা অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের এই উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্যদায়ী “গ্রীণ হাউস গ্যস” প্রধানত কলকারখানা, শক্তি উৎপাদনকেন্দ্র, যানবাহন, চাষাবাদ, খনিজ জ্বালানীতেলের ব্যবহার, বন উজাড়েরমত কার্যক্রম হতে সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের হিসাবে বর্তমানহারে গ্রিণ হাউস গ্যাস নির্গমন ও পরিবেশ দূষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দির প্রতি দশকে গড়ে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ০.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস হারে বৃদ্ধি পাবে। গত ১০০ বছরে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা গড়ে ০.৭০-২.০০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এতে করে গ্রীণ হাউস প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে, উষ্ণতা বেড়েগিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ বেড়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। এভাবে যদি পৃথিবীল উষ্ণতা এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় তাহলে বাংলাদেশেরসমুদ্র উপকুলবর্তী অঞ্চল সমূহের কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সংশ্ষিল্ট বিশেষজ্ঞদেরমতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ড়েলে বাংলাদেশের নিন্মাঞ্চলসহ প্রায় ১২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্যত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এতে করে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সন্ধীপসহ অন্যান্য দ্বীপাঞ্চলের এক বিরাট অংশ ডুবে যাবে বলেও আশংকা করা হচ্ছে।

তাহলে কুতুবদিয়া দ্বীপ কি বিলীন হয়ে যাবে?
বিগত কয়েক দশকের প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নতুন নতুন দূর্যোগ সমূহপর্যালোচনা করে যে প্রশ্নটি প্রথমেই আসে তাহলো-এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কুতুবদিয়া দ্বীপ কি আদৌটিকে থাকবে? কুতুবদিয়াদ্বীপের সৃষ্টিলগ্নের আয়তন ছিল ৯৭ বর্গমাইল।

কিন্তু শংখ নদীল প্রবল স্রোত, সামুদ্রিক ঢেউ ও ঝড় তুফানের কারণেদ্বীপের বর্তমান আয়তন ২০ বর্গমাইলে এসে পৌঁছেছে। ট্রাপিক্যাল সাইক্লোন ছাড়াও শংখ নদীর প্রবল স্রোতের কারণেও দ্বীপ ও কুতুবদিয়া কালের আবর্তে ছোট হতে হতে বর্তমানে এক পঞ্চমাংশআয়তনে এসে পৌঁছেছে। বিভিন্ন তথ্য হতে দ্বীপৈর আয়তন বিভিন্ন সময়ে নিম্মরূপ ছিল বলে জানা যায়। ১৮৮০-১৯০০ সন পর্যন্ত কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন ছিল ৫৭-৫৮ বর্গমাইল, ১৯০১-১৯৪৭ সন পর্যন্ত ৪০-৪২ বর্গমাইল, ১৯৪৮-১৯৫৯ সন পর্যন্ত ৩৪-৩৫ বর্গমাইল, ১৯৬০-১৯৭৭ সন পর্যন্ত ২৬-২৭ বর্গমাইল, ১৯৭৮-১৯৮৬ সন পর্যন্ত ২২-২৩ বর্গমাইল, ১৯৯১-১৯৯২ সন পর্যন্ত ২০ বর্গমাইল এবং ২০৫০ সালে।